রাজনীতিতে মিথ্যা বলায় লাভ বেশি?

0 ৪৮

রাজনীতিতে মিথ্যা বলায় লাভ বেশি?

Dhaka post today

নিজস্ব প্রতিনিধি

রাজনীতি সম্পর্কে যদি এমন একটি মন্তব্য করতে হয়, যা পৃথিবীর সব সমাজের জন্য প্রযোজ্য, তাহলে কোন মন্তব্যটি আপনি বেছে নেবেন? এ ক্ষেত্রে মনে হয় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মন্তব্য হবে ‘রাজনীতিবিদেরা মিথ্যা কথা বলে থাকেন’। এ ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ কেউ করবে বলে মনে হয় না। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে দাঁড়িয়ে মিথ্যা না বলার পরিণতিই–বা কী হতে পারে? রাজনীতির ময়দানে যেহেতু লড়াইটা বহুমুখী, তাই সব পক্ষ সত্য না বললে শুধু এক পক্ষ সত্য বলে কি টিকতে পারবে?

এই রাজনৈতিক দ্বিধা–দ্বন্দ্বের সিনেমাটিক রূপায়ণ দেখা গেছে ‘প্রাইমারি কালারস’ নামে ১৯৯৮ সালের একটি চলচ্চিত্রে। সেই চলচ্চিত্রে মিথ্যা দিয়ে একটি মৃত্যুকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়। এর ফলে এক তরুণ কর্মীর মোহমুক্তি ঘটে। তখন বিল ক্লিনটনের কাল্পনিক চরিত্র জ্যাক স্ট্যানটন সেই তরুণ কর্মীকে উপদেশ দিতে গিয়ে যা বলে, তার সারমর্ম হলো: নেতা হতে হলে মিথ্যা বলতে হয়। নেতা হওয়ার সুযোগ পেলে তখন মানুষের জন্য কাজ করা যায়। ফলে, সেই মিথ্যার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যায়।

এখান থেকে আমরা দর্শকেরা বুঝতে পারি, রাজনীতি করতে হলে মিথ্যা বলতে হয়। এ-ও বুঝতে পারি যে রাজনীতিতে মিথ্যা বলা শুধু আমাদের প্রাচ্য দেশীয় ব্যাপার নয়, বরং তা সারা দুনিয়ায় একই রকম।

সে জন্য সৎ থাকতে চাওয়া আবার একই সঙ্গে রাজনীতিও করার বেলায় নৈতিক দোলাচলের প্রশ্ন চলে আসে। এখানে মূল সমস্যা হলো বার্নার্ড উইলিয়ামস যাকে বলেছেন ‘মোরাল সেলফ-ইনডালজেন্স’। মানে হলো অন্য মানুষ বিপদে পড়লেও সততা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকা।

অন্যভাবে বললে, ‘নিজে সৎ আছি’ ধরনের একটা গর্ব নিয়ে থাকা। রাজনীতি আজকাল খারাপ কাজ। এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিষ্কলঙ্ক থাকার একমাত্র পথ হলো রাজনীতির পথই না মাড়ানো। তার মানে এখানে আসতে হলে সত্যের সঙ্গে ‘কিছুটা আপস’ করেই আসতে হবে। কিন্তু এর মানে কি এই যে রাজনীতি করলে নগ্নভাবে মিথ্যা বলতে হবে?

কথায় এক আর কাজে আরেক হলে নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া ছাড়াও আরেকটি ব্যাপার আছে। বলা ও করার মধ্যে এই ফারাক সাময়িকভাবে কোনো দলকে বিজয় এনে দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা ফলদায়ক নয়। বিশ্বাস একবার হারিয়ে গেলে তা ফেরত আনা কঠিন।

সামনে আমাদের নির্বাচন। রাজনীতিতে এখন বক্তব্য–পাল্টা বক্তব্য চলছে। কে সত্য বলছে আর কে মিথ্যা বলছে, তা জনগণ ঠিকই বুঝতে পারছে। কিন্তু মিথ্যা যারা বলতে চায়, তারা বলছেই। কারণ, অনুগতরা সত্য-মিথ্যার ধার ধারে না। তারা চায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণ, সত্য-মিথ্যার মিশেলে জোরালো আক্রমণ।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কোনো রাজনৈতিক পক্ষই রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের কথা বলে না। এমনকি নির্যাতিত কোনো বিরোধী দলও রাজনৈতিক এই নোংরা সংস্কৃতির পরিবর্তনের কথা বলে না। নেতা-নেত্রীর মুক্তি দিতে হবে বলে তারা স্লোগান দেয়, দাবি তোলে।

কিন্তু এই যে দুরবস্থা, তা বদলের কথা কারও মুখে শোনা যায় না। কারণ, তারা প্রত্যেকেই ক্ষমতায় গেলে বিরোধী শক্তি ও মত দমন করায় সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় গণতন্ত্রের কথা বলে মুখে যাদের ফেনা ওঠে, তারাই আবার ক্ষমতায় গেলে সেই তিমিরেই ফিরে যায়।

সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো সত্য দিয়ে মিথ্যার পাল্টা জবাব দেওয়া। অন্যরা মিথ্যা বললে সেটাকে নিজের সুযোগ হিসেবে নিয়ে সত্য দিয়ে মিথ্যাকে খোলাসা করে দেখাতে হবে।

এটা ঠিক যে ভুয়া খবরের যুগে জনগণ সচেতন থেকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে পারবে—এমনটা ধরে নেওয়ার ঝুঁকি আছে। কিন্তু জনগণের বুদ্ধিমত্তা মূল্যায়ন না করাও বোকামি। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সত্য-মিথ্যা যাচাই করাও কঠিন কাজ নয়। সাময়িকভাবে হয়তো মানুষকে বোকা বানানো যায়। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা কোনো কাজে আসে না, বরং ক্ষতির কারণ হয়।

শুভেচ্ছান্তে
ফিরোজ মল্লিক
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি,
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় জনসেবা (বিসিপি)

Leave A Reply

Your email address will not be published.