অনিশ্চয়তা বাড়ছে চিকিৎসা পেশায়

0 ৩৯

অনিশ্চয়তা বাড়ছে চিকিৎসা পেশায়


দিন দিন চিকিৎসা পেশায় অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এ অবস্থায় পেশাগত নিরাপত্তার পাশাপাশি চিকিৎসকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়ও জোর দিয়ে ভাবা উচিত

‘চিকিৎসক’ নামটা সামনে এলেই একসময় চোখের সামনে ভেসে উঠত দামি গাড়ি, মোটা অঙ্কের টাকা আর আলিশান জীবন-যাপনের চিত্র।

তবে, সময়ের পালাবদলে এ পেশা এখন ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি বিশাল সংখ্যক চিকিৎসকের প্রতিযোগিতার বাজারে শ্রমের মূল্য যেন কমে আসছে। পেশাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসা পেশায় দিন দিন অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এ অবস্থায় পেশাগত নিরাপত্তার পাশাপাশি চিকিৎসকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়ও জোর দিয়ে ভাবা উচিত।

এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে একজন এমবিবিএস পাস চিকিৎসক বেতন পান গড়ে ২০ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ। গড়ে একজন চিকিৎসক বেতন পান ১৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা। এত অল্প টাকায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবার সামলে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।

আর্থিক টানাপোড়েনে জুনিয়র চিকিৎসকরা, ভুগছেন বিষণ্নতায়

আর্থিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গে সঙ্গে কথা হয় ডা. মো. আরাফাত ইসলামের। রাজধানীর বাড্ডা এলাকার একটা ক্লিনিকে গত চার মাস ধরে ২২ হাজার টাকা বেতনে সেবা দিয়ে আসছেন তিনি। স্ত্রীসহ উত্তর বাড্ডা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন আরাফাত। সন্তান না থাকলেও পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে বাবা-মায়ের দেখাশোনার দায়িত্বও তার কাঁধে।

এত পরিশ্রম আর এত টাকা খরচ করে চিকিৎসক হয়েছি। এখন কর্মক্ষেত্রে এসে দেখছি চিকিৎসক হওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। এখনও আমাকে আরও ছয় থেকে সাত বছরের পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু এ সময় পরিবার-সংসার সামলে কীভাবে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাব— এটাও বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে
ডা. মো. আরাফাত ইসলাম

তিনি বলেন, এমবিবিএস শেষ করেছি, এখন পোস্ট-গ্রাজুয়েশনে চান্স পাওয়ার চেষ্টা করছি। এতদিন বাবা আমার পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচ বহন করলেও কিছুদিন হলো তিনি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। তাই এখন নিজের খরচ চালানোসহ পরিবারের খোঁজ-খবর রাখা আমার দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শতকরা হিসাবে কর্মক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা দেখা গেছে ৪৬.৬ শতাংশ, শারীরিক সহিংসতা ৫ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতন ছিল ১৯ শতাংশ— বিএসএমএমইউ / প্রতীকী ছবি
ডা. আরাফাত বলেন, এত পরিশ্রম আর এত টাকা খরচ করে চিকিৎসক হয়েছি। এখন কর্মক্ষেত্রে এসে দেখছি চিকিৎসক হওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। এখনও আমাকে আরও ছয় থেকে সাত বছরের পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু এ সময় পরিবার-সংসার সামলে কীভাবে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাব— এটাও বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধু ডা. আরাফাত নয়, এমন অবস্থা সদ্য এমবিবিএস পাস করা প্রায় প্রত্যেক চিকিৎসকের। এ অবস্থায় হতাশা বাড়ছে তাদের মধ্যে।

শারীরিক সহিংসতার চেয়ে প্রকট মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা

একজন চিকিৎসক নামমাত্র বেতনে চাকরি করেও কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের সহিংসতায় ভোগেন। দেশে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা নিয়ে সম্প্রতি এক সমীক্ষা চালিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ (জনস্বাস্থ্য ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ)। সমীক্ষার ফলে দেখা গেছে, দেশের হাসপাতালগুলোতে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার প্রাদুর্ভাব ছিল। যা শতকরা বিবেচনায় প্রায় ৪৮ শতাংশ।

দেশের হাসপাতালগুলোতে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার প্রাদুর্ভাব ছিল। যা শতকরা বিবেচনায় প্রায় ৪৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে শারীরিক সহিংসতার চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতাই বেশি ছিল।

যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল যৌন নির্যাতনের ঘটনাও। শতকরা হিসাবে কর্মক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা দেখা গেছে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ, শারীরিক সহিংসতা ৫ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতন ছিল ১৯ শতাংশ— বলছে বিএসএমএমইউ’র সমীক্ষা
এক্ষেত্রে শারীরিক সহিংসতার চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতাই বেশি ছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিল যৌন নির্যাতনের ঘটনাও। শতকরা হিসাবে কর্মক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা দেখা গেছে ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ, শারীরিক সহিংসতা ৫ শতাংশ এবং যৌন নির্যাতন ছিল ১৯ শতাংশ।

সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার উচ্চ প্রাদুর্ভাব (৪৮ শতাংশ) হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতাল-প্রশাসনে সহিংসতার রিপোর্টের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। শতকরা বিবেচনায় যা প্রায় ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা রিপোর্ট করতে আগ্রহীদের সহিংসতার অভিজ্ঞতা কম ছিল। এমনকি কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার অংশগ্রহণকারীদের জীবনযাত্রার মানও কম ছিল।

জানা গেছে, এ গবেষণার জন্য মোট ১৯ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়। চিকিৎসক ও নার্স উভয়কেই এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

প্রশ্নপত্রের নকশা করা হয়েছিল অংশগ্রহণকারীদের সামাজিক-জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্য, কর্মক্ষেত্রের তথ্য, কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা ও জীবনযাত্রার মান ব্যবহার করে। লজিস্টিক রিগ্রেশন করা হয়েছিল স্বাস্থ্যকর্মীর কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার সঙ্গে অংশগ্রহণকারীদের জনসংখ্যা বিষয়ক বৈশিষ্ট্য এবং কর্মক্ষেত্র বিষয়ক ভ্যারিয়েবলগুলোর মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করার জন্য।

চিকিৎসক সুরক্ষিত হলেই আপনার স্বাস্থ্যের সুরক্ষা মিলবে : ডা. সাকলায়েন রাসেল

ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. সাকলায়েন রাসেল বলেন, প্রায় সময়ই কর্মক্ষেত্রে রোগীর স্বজন কর্তৃক স্বাস্থ্যকর্মীরা হামলা-মামলার শিকার হন। তাদের মনে রাখা উচিত যে আপনার চিকিৎসক যদি সুরক্ষিত হয়, তিনি আপনার সুরক্ষার দায়িত্বও সঠিকভাবে পালন করতে পারবেন।

আপনি একজন চিকিৎসককে এতগুলো বিদ্যার মাধ্যমে আমাদের একটা গর্বিত প্রতিনিধি করলেন, কিন্তু মাস শেষে আপনি তাকে বেতন দিচ্ছেন ২০ থেকে ২১ হাজার টাকা! খুব বেশি হলে ২৫ হাজার টাকা! চিত্রটা যদি আমি ঢাকার বাইরে চিন্তা করি, তাহলে চিকিৎসকের বেতন হয়ে যাচ্ছে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা! এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেসব চিকিৎসক বের হয়ে আসছেন তাদের থেকে কতটুকু ভালো ব্যবহার আমরা প্রত্যাশা করতে পারি
ডা. সাকলায়েন রাসেল
‘আমরা যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের সঙ্গে সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করি, তখন আমরা বুঝতে পারি তাদের চেয়ে আমরা কোনো দিক থেকেই পিছিয়ে নেই।

তথ্যপ্রযুক্তি বা আমাদের চিকিৎসকদের দক্ষতার দিক থেকে এখন আমরা বেশ এগিয়ে। বরং কিছু ক্ষেত্রে আমরা অন্যদের তুলনায় ভালো করছি। এমনকি বাংলাদেশ থেকে যেসব চিকিৎসক চাকরি নিয়ে দেশের বাইরে যাচ্ছেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থায়ী হচ্ছেন, তারা কিন্তু সেসব দেশে সেরা চিকিৎসক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন।’

Leave A Reply

Your email address will not be published.