ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে উত্তেজনা এবং ছাত্রদের দুই গ্রুপের মধ্যে
ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে উত্তেজনা এবং ছাত্রদের দুই গ্রুপের মধ্যে
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে উত্তেজনা এবং ছাত্রদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা দিনজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ঘটনাটি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ঘটলেও এর প্রভাব পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে। কুয়েট শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের হামলার অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
ক্যাম্পাস প্রতিনিধি সূত্রে জানা গেছে, কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দফায়-দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আজ (মঙ্গলবার) দুপুর থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের কুয়েটের অ্যাম্বুলেন্সে করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সংঘর্ষ থামলেও কুয়েট ও আশপাশের এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত রয়েছেন। এ ছাড়া বিজিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুই প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ আছে। কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি আবার শুরু হতে পারে, সে সম্ভাবনা থেকে ছাত্রদলের কর্মীরা গতকাল ১৭ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাসে লিফলেট বিতরণ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আজ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্ররাজনীতির ঠিকানা, এই কুয়েটে হবে না’, ‘দাবি মোদের একটাই, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’, ‘এই ক্যাম্পাসে হবে না, ছাত্ররাজনীতির ঠিকানা’- সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো প্রদক্ষিণ করেন। এ সময় ছাত্রদলের কর্মীরা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়, যা কুয়েটের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। কুয়েট পকেট গেট থেকে বহিরাগতরা ছাত্রদলের পক্ষ নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
সেখানকার ছাত্রদলের এক নেতা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ছাত্রশিবিরের অংশ এবং পতিত সরকারের ছাত্রসংগঠনের পক্ষের দু-একজন মিলে ক্যাম্পাস থেকে এবং ক্যাম্পাসের আশপাশে ছাত্রদলের রাজনীতি বাধাগ্রস্ত করতে চায়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদ সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, কুয়েটে ছাত্রদল নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ স্টাইলে যে নৃশংস হামলা চালাচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদল নিজেদের রাজনৈতিক কবর রচনার পথেই অগ্রসর হলো।
কুয়েট সিভিল বিভাগের ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী রাহাতুল ইসলাম বলেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে ভিসির কাছে গেলে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা আমাদের হুমকি দেন। তারা সিনিয়রদের লাঞ্ছিত করেন। আমরা ভিসির কাছে এই বিচার দিয়ে বের হয়ে আসার পর বিনা উসকানিতে আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরা তাদের ধাওয়া দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছি। পরে আশপাশের এলাকার বিএনপির লোকজন সঙ্গে নিয়ে তারা আবার হামলা চালান। এতে অসংখ্য ছাত্র আহত হয়েছেন।
এদিকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রদলের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মঙ্গলবার রাত ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এই বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি ভিসি চত্বর ঘুরে ফের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়।
সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক জাকির হোসেন মঞ্জু বলেন, আবার যদি কেউ ছাত্রলীগের মতো ফিরে আসতে চায়, আর যদি কেউ আমাদের ভাইদের ওপর হামলা করে তবে তাদেরকে প্রতিহত করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আবার রাজপথে নামবে। নতুন বাংলাদেশে ছাত্রলীগের স্টাইল ও ফ্যাসিবাদী কায়দায় হামলা চলবে না।
সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, জুলাই-আগস্টে যে নির্মম নিপীড়নের মধ্য দিয়ে আমাদের লড়াই করতে হয়েছে সেই নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়ন আবার ফেরত এসেছে। ছাত্রলীগের স্টাইলে হামলাকে জায়েজ করছে অনেকে। ৫ আগস্টের পরে আমরা আর জাহেলি আমলে ফেরত যেতে চাই না। যারা আবার ছাত্রলীগের মতো হতে চাইবে তাদের বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়াব। এ দেশে স্ট্যাম্প ও লাঠির, রামদার রাজনীতি চলবে না। প্রয়োজনে আমরা আবার একটি জুলাই বরণ করতে প্রস্তুত আছি।
আরিফ সোহেল বলেন, আমরা বলে দিতে চাই, পাঁচ আগস্টের পরে দেশের প্রতিটি মানুষের জান ও মাল হারাম হবে। কারো জান ও মালের ক্ষতি করার অধিকার কারো নেই। আমরা পাঁচ আগস্টের পূর্বের বাংলাদেশে ফেরত যাব না। জুলাই-আগস্টে আমাদের ভাই-বোনেরা অহেতুক শহিদ হন নাই। তাদের রক্তের দায় আমাদের ওপরে। যে কেউ ছাত্রলীগের মতো বিভিন্ন পন্থায় হামলা করে তা জায়েজ করার চেষ্টা করবে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব। আমরা কারো সঙ্গে আপস করব না।
বিক্ষোভ মিছিল শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করছি আমাদের সেই স্বাধীনতার রক্ষা করতে হবে। আমাদেরকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর কোনো সন্ত্রাসের ঠিকানা হবে না।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই, যুবলীগের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এই লড়াই একটা বিপ্লবের। আমাদের লড়াই শেষ হয়ে যায় নাই। আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করছি আমাদের সেই স্বাধীনতার রক্ষা করতে হবে। আমাদেরকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর কোনো সন্ত্রাসের ঠিকানা হবে না। কুয়েটে নারকীয় ছাত্রলীগ স্টাইলে যে ধরনের নির্যাতন হয়েছে। আমরা তাদেরকে সতর্ক করতে চাই।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্রলীগ-কুত্তালীগ যে পথে, ছাত্রদল সেই পথে’, ‘সন্ত্রাসীদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ, সন্ত্রাসী মুর্দাবাদ’; ‘কুয়েটে রক্ত ঝরে, ওয়াসিম তোমায় মনে পড়ে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, আবু সাঈদ, ওয়াসিমরা যে সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের জন্য শহীদ হয়েছেন তাদের সেই ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আমি ছাত্রদলের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা ফ্যাসিবাদী আমলে যে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন এটা কি সেই গণতন্ত্র? আমরা প্রবল শক্তিশালী ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করেছি। ছাত্রদলকে তো আমরা কালকে ক্যাম্পাসে নিয়ে এসেছি। তাদের বিতাড়িত করতেও সময় লাগবে না।