সন্ধ্যা পেরোলে আতঙ্কে থাকতে হয় নিজের ক্যাম্পাসেই
সন্ধ্যা পেরোলে আতঙ্কে থাকতে হয় নিজের ক্যাম্পাসেই
বগুড়া জেলা প্রতিনিধি
উত্তরের অন্যতম পুরোনো বিদ্যাপীঠ বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে শিক্ষার্থীদের পাঁচটি আবাসিক হলের চারটিই বন্ধ। প্রায় ছয় বছর আগে ছাত্রীদের জন্য নির্মাণ করা একটি হলে এখনো শুরু হয়নি আবাসন ব্যবস্থা। পরিত্যক্ত হল এবং নিরাপত্তাহীন ক্যাম্পাসে হরহামেশা ঘটছে চুরি, ছিনতাইসহ ডাকাতির ঘটনা। অন্যদিকে কলেজের একমাত্র সচল ‘বেগম রোকেয়া’ হলে ২৫০ আসনের বিপরীতে গাদাগাদি করে থাকছেন চারশ’র অধিক ছাত্রী।
১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি আজিজুল হক কলেজে অধ্যায়নরত ছাত্র-ছাত্রী এখন প্রায় ২৫ হাজার। তাদের বেশিরভাগই বগুড়ার বাইরে থেকে পেড়তে এসেছে। কলেজে এত শিক্ষার্থীর বিপরীতে আবাসন ব্যবস্থা একেবারে নগণ্য। তারা কলেজের আশপাশে বিভিন্ন মেসে থেকে লেখাপড়া করছেন। এতে করে তাদের খরচ বাড়ছে প্রায় ৩ থেকে ৪ গুণ।
সরকারি এই কলেজটিতে ছেলেদের জন্য শের-ই-বাংলা হল, আকতার আলী মুন হল ও তিতুমীর হল বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগ ২০০৪ সালের এই হলগুলো নির্মাণ করেন। তার ৫ বছর পর ২০০৯ সালের ২০ ডিসেম্বর হল দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবির কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বন্ধ ঘোষণা করা হয় শের-ই-বাংলা হল, আকতার আলী মুন হল ও তিতুমীর হল। সেই যে বন্ধ হয়েছে, এরপর আর খোলা হয়নি হল তিনটি। ২০১৬ সালে আক্তার আলী মুন হল ও ২০১৯ সালে শহিদ তিতুমীর হল সংস্কার করা হলেও পরবর্তী সময়ে চালু করা হয়নি।
অপরদিকে মেয়েদের জন্য নির্ধারিত ২টি হলের একটি বেগম রোকেয়া হল। ২০১৮ সালে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত ছাত্রী হল ৬ বছরেও চালু করতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ। এতে করে দূর-দূরান্ত থেকে আগত মেয়েদের দুর্ভোগ ও খরচ দুটোই বাড়ছে।
জেলার বাইরের শিক্ষার্থীরা আবাসন সুবিধা তো পাচ্ছেই না বরং সন্ধ্যা পেরোলে আতঙ্কে থাকতে হয় নিজের ক্যাম্পাসেই। কলেজ চত্বর ও এর আশপাশের সড়কগুলোতে খুন, ছিনতাই তো হয়ই, ঘটেছে পুলিশ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাতের ঘটনাও।
এদিকে ছেলেদের বন্ধ তিনটি হলের শের-ই-বাংলা হল একেবারে পরিত্যক্ত। কঙ্কালসার এই হলটির জানলা-দরজাসহ খুলে নিয়ে গেছে সব কিছু। এখন হলটি মাদকসেবীদের আখড়া। নিরাপত্তা নিশ্চিতে তাই কলেজ প্রশাসনের অধীনে কলেজের হল চালুর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়ার দাবি শিক্ষার্থীদের।
সরকারি আজিজুল হক কলেজের বাংলা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রায়হান বলেন, সোনাতলা থেকে পড়াশোনার জন্য বগুড়া এসেছি। আমার বাবা কৃষিকাজ করেন। পরিবারের খরচ চালানোর পাশাপাশি আমাদের ৩ ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচও চালান তিনি। ভেবেছিলাম কলেজ হলে উঠে অল্প খরচে পড়াশোনা চালাব কিন্তু হল বন্ধ থাকায় প্রায় ৩/৪ গুণ খরচ বেড়েছে। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার করে সবকটি হল চালু করা হোক।
কলেজের নিকটবর্তী পুরান বগুড়া এলাকার মেস ছাত্র সাগর রহমান বলেন, আমাদের মেসের জীবন দেখলে যে কেউ অবাক হবে। কোনো সুস্থ মানুষ এখানে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে। এই এলাকার মেসগুলো পুরানো ও নীচু। তাই বর্ষায় আমাদের ঘরগুলোতে হাঁটুপানিও জমে থাকে। এছাড়া পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সমস্যা তো আছেই। এত কিছু মেনে নিয়ে পড়াশোনা করে বেঁচে থাকাই এখন দায় হয়ে পড়েছে।
জীববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র সোহরাব হোসেন বলেন, পড়াশোনার জন্য আমাদের অনেক সময়ী সন্ধ্যার পরে ক্যাম্পাসে থাকতে হয়। হলগুলো বন্ধ থাকার কারণে সন্ধ্যার আগেই সবাই নিজ নিজ মেসে চলে যায়। তারপরই মাদকসেবীদের দখলে চলে যায় কলেজের বিভিন্ন স্থান। কলেজের পিছনের যে রাস্তাটি রয়েছে এই রাস্তায় ছিনতাই ও ডাকাতি ঘটে হরহামেশা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
বেগম রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী সালম আখতার বলেন, আমাদের এই কলেজটিতে একমাত্র সচল হল এটি। আমরা যখন ভর্তি হই তখন মেয়েদের জন্য নির্ধারিত ২টি হলের কথা বলা হয়। পরে আমরা একটি হল সচল পাই কিন্তু সেখানেও ছিট নিতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। আমাদের বেগম রোকেয়া হলে আসন অনুযায়ী যত জন ছাত্রী থাকার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি ছাত্রী এখানে থাকে। একেতো ছাত্রী সংখ্যা বেশি আবার হলের পরিবেশও অনেক খারাপ।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. শওকত আলম মীর বলেন, শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘব করতে যত দ্রুত সম্ভব ছাত্রাবাসগুলো খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। ২০০৯ সালে বন্ধ করে দেওয়া হলগুলো ব্যবহার না হওয়ায় বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সংস্কার করে আবাসন উপযোগী করতে বড় বরাদ্দ প্রয়োজন। তবে মেয়েদের জন্য ছয় বছর আগে নির্মাণ করা হলের বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ শেষ হলেই আবাসন শুরু হবে। সংস্কার করে হলগুলো চালু করলে স্বল্প খরচে পড়াশোনা করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে পদচারণা বাড়বে শিক্ষার্থীদের। এতে যেমন কমবে ছিনতাই ডাকাতিসহ মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্য। তেমনি ক্যাম্পাস ফিরে পাবে নতুন প্রাণ।