১৯৭১ সালের এই দিনে কেরানীগঞ্জের ভয়াল গণহত্যা দিবস আজ
১৯৭১ সালের এই দিনে কেরানীগঞ্জের ভয়াল গণহত্যা দিবস আজ
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি
কেরানীগঞ্জের ভয়াল গণহত্যা দিবস আজ (২ এপ্রিল)। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কেরানীগঞ্জের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই হামলায় প্রায় ৫ সহস্রাধিক নারী-পুরুষ-শিশু শহীদ হন। এদের মধ্যে কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৬শ’ জন শহীদ হয়েছেন। বাকিরা রাজধানী ঢাকার। ১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী রাজধানী ঢাকার ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের উপর আকস্মিকভাবে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। তখন রাজধানী ঢাকার হাজার হাজার মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নিতে থাকে।
এদিকে, পাক হানাদার বাহিনী মনে করতো কেরানীগঞ্জের নেক রোজ বাগে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। এই ট্রেনিং সেন্টারে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে রাজধানী ঢাকায় পাক হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালানো হয়। এই সংবাদের ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল খুব ভোরে কেরানীগঞ্জে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর পাক হানাদার বাহিনী হামলা চালায়। সদরঘাট, বাদামতলী ঘাট ও সোয়ারীঘাট থেকে পাক হানাদার বাহিনী কেরানীগঞ্জের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মাঝে মাঝে তারা মর্টারশেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এতে কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, আগানগর, শুভেচ্ছা ও কালিন্দী ইউনিয়নের মানুষ এবং এসব এলাকায় রাজধানী ঢাকা থেকে আসা আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার লোক প্রাণভয়ে দিগ্বিদিগ ছোটাছুটি করতে থাকে। এসব মানুষ কেরানীগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য দৌড়াতে থাকে। পাক বাহিনী অতি সুকৌশলে এসব এলাকা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। ফলে যেসব লোকজন রাস্তাঘাট ও মাঠ দিয়ে দৌড়িয়ে পালাচ্ছিলো তাদেরকে লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা।
আবার অনেকেই ঘরের মধ্যে নিচু জায়গায় প্রাণ ভয়ে আশ্রয় নেয়। এসব অসহায় মানুষও পাকনাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। পাকসেনারা গ্রামের ভিতর প্রবেশ করে ঘরের ভিতর পালিয়ে থাকা লোকজনকে খুঁজে খুঁজে বের করে তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। একাধারে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা এই আক্রমণ চালায়। এতে নাম না জানা শত শত পথচারী, শিশু, গর্ভবতী মহিলা ও নববিবাহিত দম্পতিসহ প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ পাক সেনাদের হাতে প্রাণ বিসর্জন দেন।
জিনজিরার মনুবেপারির ঢালে একটি বাড়ির পাশের গর্তে প্রায় ৫০ জন লোক এবং অপর একটি গর্তে প্রায় ৪৫ জন লোক আশ্রয় নিয়েছিল। পাক সেনারা এসব লোকজনকে ধরে এনে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। এসব লাশের যাদের পরিচয় পাওয়া যায় তাদেরকে স্বজনদের হাতে হস্তান্তর করা হয়। আর যাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি তাদেরকে এই মনু ব্যাপারীর ঢালে একটি গর্তে গণকবর দেওয়া হয়। নজরগঞ্জ এলাকায় একই পরিবারের চার সহোদর ভাইকে গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। এসময় তাদের ঘরে আশ্রয় নেওয়া একই পরিবারের নাম না জানা মা, বাবা, ভাই-বোন কে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে।
নজরগঞ্জ কবরস্থানে একই কবরে ১৭ জনকে গণকবর দেওয়া হয়। অমৃতপুর এলাকায় এক মহিলার স্বামীকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করার পর ওই মহিলা তার এক শিশু কন্যাকে কাঁধে নিয়ে প্রাণভয়ে দৌড়িয়ে পালাতে থাকে। কখন যে পাক সেনাদের একটি গুলির আঘাতে তার শিশুর মাতা দেহ থেকে বিছিন্ন হয়েছে সেদিকে তার কোন খেয়াল ছিল না। কিন্তু, দৌড়াতে দৌড়াতে অনেক দূরে গিয়ে যখন তিনি বুঝতে পারল যে তার কন্যা শিশুটির মাথা নেই তখন এই দৃশ্যটি দেখে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। মান্দাইল এলাকায় এক ব্যক্তি তার শিশু কন্যাকে কাঁধে নিয়ে পালাবার সময় পাক সেনাদের গুলিতে তিনি নিহত হলে তার অবুঝ শিশু কন্যাটি বাবার লাশের উপর শুয়েছিল। কালিন্দী এলাকায় একটি করলা ক্ষেতে শত শত অসহায় মানুষকে পাক সেনারা গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদেরকে একই জায়গায় গণকবর দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালে এই দিনে পরিকল্পিতভাবে পর্যায়ক্রমে পাক সেনারা জিনজিরা, আগানগর, চরকুতুব, গোলামবাজার, ডাকপাড়া, চরাইল, ভাগনা, বোরহানিবাগ, অমৃতপুর, হুক্কা পট্টি, হাউলী, লসমনগঞ্জ, গুলজারবাগ, ছাটগাঁও, নজরগঞ্জ, মান্দাইল, মনুবেপারী ঢাল, কুইশারবাগ, বরিশুর, কালিন্দী ও নেকরোজবাগ এলাকায় নিষ্ঠুরভাবে হামলা চালায়। এতে এসব এলাকার নিরহ লোকজনসহ ঢাকা থেকে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৫ সহস্ত্রাধিক মানুষ পাক সেনাদের হাতে শহীদ হন।
এই শহীদের স্মরণ করার জন্য সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব আমান উল্লাহ আমান জিনজিরার মনুব্যাপারীর ঢালে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। এই দিবস টি পালন উপলক্ষে কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সামাজিক সংগঠন ও কেরানীগঞ্জ প্রেসক্লাব দিনভর অনুষ্ঠান পালন করবে।