ভুয়া মামলা সাজিয়ে মীমাংসার জন্য বাসায় গিয়ে মোটা অংকের টাকা

0 ১৬

মামলা মীমাংসার জন্য বাসায় গিয়ে মোটা অংকের টাকা

 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া। গত বছর যখন দেশ জুড়ে সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয় তার আগেই সপরিবারে কানাডায় নিজের ছোট ভাইয়ের কাছে ঘুরতে গিয়েছিলেন। সেখান থেক দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা পালানোরও এক মাস পরে। তবে দেশে না থেকেও রাজধানীর উত্তরায় জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত এক ব্যক্তিকে পেটানোর অভিযোগে ৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে তাকে। মামলার বাদীর ভাষ্য- তিনি আসামি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। সব করেছেন স্থানীয় ‘রাজীব ভাই’। আর এই রাজীবই মামলা মীমাংসার জন্য নজরুলের বাসায় গিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করেছেন। টাকার বিনিময়ে মামলাটি থেকে অন্য আসামিরও নাম কাটিয়ে দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন এই কথিত রাজনৈতিক নেতা রাজীব খান। এমন কী মামলার নথিতে উল্লেখ করা বাদীর মোবাইল নম্বরটিও এই রাজীবের।  

গত ফেব্রুয়ারি মাসে এডভোকেট শফিকুল ইসলাম সবুজের মাধ্যমে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদলতে দায়ের করা মামলার নথিতে দেখা যায়, ১৪৭/১৪৮/৩২৩/৩২৬/৩০৭/৩৪ ধারায় মামলাটি করেন তুরাগের হামুর বটতলা এলাকার মো. আ: খালেক হাওলাদারের ছেলে মো. নূর মোহাম্মদ রনি। আর মামলাটির ১ নম্বর আসামি হচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসামির তালিকায় আছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জাতীয় পার্টির সভাপতি জিএম কাদের, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, ওই এলাকার সাবেক এমপি হাবিব হাসান প্রমুখ। মামলাটিতে মোট ৩৩৩ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ৫০/৬০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।

নথিতে বাদী উল্লেখ করেছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যখন উত্তাল, তখন রাজপথে কোটা বিরোধীর দাবিতে ছাত্র-জনতা হিসেবে আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ওই আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৮ই জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানাধীন রাজউক কমার্শিয়াল কমপ্লেক্সের সামনে শহীদ মুগ্ধ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তখন আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং ছাত্ররা পুলিশের প্রতি আক্রোশ হয়ে স্ল্লোগান ও মিছিল করতে থাকে। এরই মধ্যে পুলিশ ছাত্র- জনতার ওপর আবারো গুলি করলে বাদী গুলিবিদ্ধ হন এবং এজাহারে উল্লিখিত ১ থেকে ৩৩ নম্বর আসামি লাঠিসোটা, রড, রামদা, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধাওয়া দিয়ে বাদীকে প্রচণ্ড মরধর করে। একই সঙ্গে বাদীকে শারীরিকভাবে অমানবিক নির্যাতন করে। বাদী নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তখন অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তাকে উদ্ধার করে উত্তরা আরএমসি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া dhaka post news কে বলেন, আমি একজন সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী।উত্তরা-৩ নম্বর সেক্টরে আমার বাসা। আমি কখনোই কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। তিনি বলেন, আমার ভাইসহ অনেকেই কানাডায় বসবাস করেন। গত বছরের ২৪ শে মে আমি আমার একমাত্র মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য কানাডা যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিমানের টিকিট কাটি। তখন দেশে সরকার পতন বা কোটা বিরোধী কোনো আন্দোলনেরই নাম-গন্ধও ছিল না। এরপর আমি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য মাস খানেক অপেক্ষায় ছিলাম। সেটা না হওয়ায় আমি জুলাইয়ে পরিবারের সঙ্গে ভাইয়ের কাছে কানাডায় চলে যাই। সেখানে যাওয়ার পর শুনি দেশে আন্দোলন শুরু হয়েছে। আন্দোলনের সময় পরিবারের কেউ দেশে আসতে দেয়নি। এরপর সব ঠাণ্ডা হলে ৩রা সেপ্টেম্বর আমি দেশে ফিরি। সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল। এরই মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে হঠাৎ রাজীব নামে এক লোক আমাকে ফোন করে জানায়- তার বাসা আগে আমার বাসার কাছে ছিল। তার জন্ম এই উত্তরা-৩ নম্বর সেক্টরে।

তিনি আমাকে চিনেন। তিনি বলেন, আমার নামে নাকি জুলাই আন্দোলনের মামলা হয়েছে। আমাকে তিনি চিনেন বলে আমি যেন কোনো ঝামেলাই না পড়ি এইজন্য তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। একই সঙ্গে তিনি আমার ইমো নম্বরে ওই মামলা সংক্রান্ত কাগজের ছবি পাঠান। যেখানে সাবেক এমপি খসরুর পরই আমাকে ৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে। তবে এডভোকেটের সিল সংবলিত ঢাকা সিএমএম কোর্টে করা ওই মামলার নথিতে কোনো মামলা নম্বর ছিল না। সব কিছু মিলে হঠাৎ যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। আমার মাথায় তখন কিছুই আসছিল না। এরপর ওই রাজীবসহ দুইজন ব্যক্তি আমার বাসায় আসেন। যার সিসিটিভি ফুটেজ আমার কাছে রয়েছে। তারা আমার বাসায় এসে একটি মামলার নথি দেখিয়ে বলেন- আমি ৭ নম্বর আসামি। আমাকে তারা ভালো জানে বলে, আমার নাম মামলা থেকে কাটিয়ে দিতে চান।

একই সঙ্গে সাড়ে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে অন্য একজনের নাম মামলা থেকে কাটিয়ে দিয়েছেন বলেও আমাকে আশ্বস্ত করেন। বলেন, একজনের নাম কাটিয়ে দিয়েছি। এমনকি ওই বাদীর সঙ্গে আমাকে মোবাইলে কথা বলিয়ে দেয়। বাদী আমাকে বলেন- তিনি আমাকে চিনেন না। মামলার বিষয়ে রাজীব ভাই যা বলবেন তিনি তাই করবেন। টাকা-পয়সার বিষয়ে রাজীব ভাই শেষ কথা। তার সঙ্গে আলাপ করেন। আমি তাকে লাখখানেক টাকা দিতেও রাজি হই। পরে বিষয়টি আমি আমার এক পরিচিতের মাধ্যমে সিএমএম কোর্টে যাই। সেখানে গিয়ে তার মাধ্যমে পিপি’র সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করি। তখন পিপি’র সহযোগী ওই মামলা দায়ের করা এডভোকেট শফিকুল ইসলাম সবুজকে ডেকে আনেন। তার কাছ থেকেই মামলার নম্বর জানতে পারি।

 

 

নজরুল ইসলাম বলেন, আমি আমাদের এই উত্তরা-৩ সেক্টরের কল্যাণ সমিতির পদে ছিলাম। ওই কমিটিতে পদ থাকার কারণেই ২০২২ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে আমাকে জামায়াত-শিবির আখ্যা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মাদকসহ মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। তখন পুলিশ তদন্ত করে দেখে- কল্যাণ সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। আর এখন আওয়ামী লীগ দেশ ছেড়ে পালানোর পর আমাকে আবার আওয়ামী লীগ ট্যাগ দিয়ে মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে।

 

 

কথিত রাজনৈতিক নেতা রাজীব খান বলেন, আমি এই সবের কিছুই জানি না। আমি আগে ৩ নম্বর সেক্টরে থাকতাম। আমি জানি নজরুল ইসলাম কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তার নামে মিথ্যা মামলা হয়েছে বলে আমি ভালো বুঝে তার দারোয়ানকে জানাই। পরে সে আমাকে একের পর এক ফোন দিতে থাকে। আমি বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে তার বাসায় যাই। মামলার বাদী আমার চেনা পরিচিত না। তারপরও আমি বাদীকে খুঁজে বের করে বিষয়টি মীমাংসা করে দিতে চেয়েছিলাম।

টাকার বিনিময়ে ওই মামলার আরেক আসামির নাম কাটার বিষয়ে তিনি বলেন, হ্যাঁ এটা সত্য সাড়ে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে আমার মাধ্যমেই আরেকজনের নাম কাটতে বাদীর কাছ থেকে এফিডেভিড করা হয়। সেখানে তারা খুশি হয়ে আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিল। ‘আপনি নিজে বাদীকে সঙ্গে নিয়ে উকিলের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে মামলা করিয়েছে’-এমন প্রশ্নের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি কখনোই এডভোকেট সবুজকে দেখিনি। তাকে চিনিও না। আমি বাদীকেও চিনি না। মামলার নথিতে আমার মোবাইল নম্বরটি কাকতালীয়ভাবে গিয়েছে। আমি কয়েকদিন একজনকে আমার ওই নম্বরটি ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম। সেখান থেকেই হয়তো নম্বরটি যেতে পারে।

এ বিষয়ে বাদীর পক্ষে আদালতে মামলা রুজু করা আইনজীবী শফিকুল ইসলাম সবুজ dhaka post news কে ’ বলেন,  আমি রাজীবকে চিনতাম না। আমাদের এক ছোট ভাই তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে নাকি আমাকে আগে থেকে চিনে। ওই রাজীবই বাদী মো. নূর মোহাম্মদ রনিকে সঙ্গে নিয়ে আমার চেম্বারে আসে। তারা দুজন ছিল। এসে বলে একটা মামলা করতে হবে। রাজীবের কথার প্রেক্ষিতেই আমি তাদেরকে মামলা করতে সাহায্য করি। এখানে আমার কোনো বিষয় নেই। এটা আমার পেশা।

মামলার বিষয়ে জানতে নথিতে দেয়া বাদীর ঠিকানা তুরাগের বটতলা এলাকাতে গিয়ে বাদী মো. নূর মোহাম্মদ রনির সন্ধান পাননি এই প্রতিবেদক। উপরন্তু মামলার নথিতে তার মোবাইলের নম্বরের স্থলে রয়েছে রাজীবের নম্বর। তাই অনেক চেষ্টা করেও বাদীর বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে জুলাই আন্দোলনে পুলিশের ছররা গুলিতে রনি আহত হয়েছিল বলে সত্যতা পাওয়া  গেছে।

মামলার তদন্তের বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান dhaka post news কে বলেন, আমাদের কাছে জুলাই আন্দোলনের কোনো মামলা বর্তমানে তদন্তাধীন নেই। আদালত থেকে যত মামলা আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল তা অনেক আগেই তদন্ত করে রিপোর্ট আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.