৩ মে পালিত হয় বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
৩ মে পালিত হয় ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস
dhaka post news
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রতি বছর ৩ মে পালিত হয় ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’। ১৯৯১ সালে আফ্রিকার নামিবিয়ার রাজধানী উইন্ডহকে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর এক সেমিনারে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ‘উইন্ডহোক ঘোষণা’ গৃহীত হয়। এই ঘোষণাপত্রে স্বাধীন, বহুত্ববাদী ও মুক্ত গণমাধ্যমের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়, যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য অপরিহার্য।
এই ঘোষণার ওপর ভিত্তি করেই ৩ মে তারিখটিকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। ১৯৯৩ সাল থেকে এটি মূলত শুরু হয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও পেশাগত অধিকার সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধিই এই দিবসের মূল লক্ষ্য।
এবার বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রতিপাদ্য “Reporting in the Brave New World: The Impact of Artificial Intelligence on Press Freedom and the Media” অর্থাৎ ‘নতুন বিশ্বে সংবাদ পরিবেশন : সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব’।
এই প্রতিপাদ্যটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তির সংবাদপত্র স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের উপর প্রভাবকে কেন্দ্র করে নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই দিবসটির তাৎপর্য অনেক। একদিকে যেমন সংবিধান গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে বাস্তবে সাংবাদিকদের নানাবিধ চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়।
আইনি কাঠামো ও সাইবার নিরাপত্তা আইন
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০১৮ সালে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA) প্রণয়ন করে, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করে। ২০২৩ সালে এটি বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন (CSA) প্রণীত হয়। তবে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, CSA-তে DSA-এর ৬২টি ধারার মধ্যে ৫৮টি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, যা সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হুমকির মুখে ফেলেছে ।
এদিকে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের ফলে হাসিনার পতনের পর ২০২৪ সালের নভেম্বরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার CSA বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ‘স্পিচ অফেন্স’ সম্পর্কিত মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। তবে নতুন আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া এখনও চলমান।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও প্রেস ফ্রিডম সূচক
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান চিন্তা, বিবেক ও বাক্স্বাধীনতাকে নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ ৩৯(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার, নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
তবে এই স্বাধীনতার সাথে কিছু যুক্তিসংগত বিধিনিষেধও আরোপ করা হয়েছে। এদিকে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও আইনি হুমকির কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৫তম স্থানে রয়েছে, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকটকে স্পষ্ট করে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জসমূহ
বাংলাদেশে প্রায়শই সাংবাদিকরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলা, মামলা, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হন। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকরা রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি বা অপরাধী চক্রের রোষানলে পড়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি লক্ষণীয়। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের এক দশকেরও বেশি সময় পরেও তদন্ত শেষ না হওয়া এবং দোষীদের চিহ্নিত করতে না পারা বিচারহীনতার একটি প্রকট উদাহরণ। এটি সাংবাদিকদের নিরাপত্তাহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
আইনি হয়রানি ও ভীতি
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (বর্তমানে সাইবার নিরাপত্তা আইন) এবং মানহানির মামলা সাংবাদিকদের হয়রানি করার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের সমালোচনা বা ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে অনেক সাংবাদিককে এসব আইনের আওতায় মামলার শিকার হতে হয়েছে; বিশেষ করে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে। এমনকি কারাবরণও করতে হয়েছে। এটি গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি করে।
সেল্ফ-সেন্সরশিপ
মামলা, হামলা বা চাকরি হারানোর ভয়ে অনেক সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যম নিজেরাই স্পর্শকাতর বা বিতর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে চলেন। সরকারের নীতি বা প্রভাবশালী মহলের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। ফলে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও সংবাদ জনসমক্ষে আসে না, যা তথ্যের অবাধ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করে।
গণমাধ্যমের মালিকানা ও রাজনৈতিক প্রভাব
বাংলাদেশের অধিকাংশ মূলধারার গণমাধ্যম বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মালিকানাধীন। এর ফলে, সম্পাদকীয় নীতি অনেক ক্ষেত্রেই মালিকপক্ষের ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়। অনেক সময় মালিকপক্ষের চাপে বা তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য সংবাদ পরিবেশনে আপস করতে হয়, যা গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তথ্য প্রাপ্তিতে বাধা
তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ থাকা সত্ত্বেও সাংবাদিকদের অনেক সময় সরকারি বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কর্মকর্তারা তথ্য দিতে গড়িমসি করেন বা তথ্য গোপন করার চেষ্টা করেন, যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করে।
গণমাধ্যমের ভূমিকা ও গুরুত্ব
এতসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। গণমাধ্যম জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করে, সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে, জনমত গঠন করে এবং সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জাতীয় সংকটের সময়ে গণমাধ্যম জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক তথ্য প্রচারে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। অনলাইন এবং মূলধারার অনেক গণমাধ্যম এখনও সাহসিকতার সাথে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সংবাদপত্র স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। এই দিবসটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকারের বিষয়গুলোকে নতুন করে সামনে নিয়ে আসে। এটি সরকার, নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যম কর্মীদের নিজেদের অবস্থান পর্যালোচনা করার এবং বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দেয়। এই দিনে আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা সভা ও মানববন্ধন সাংবাদিকদের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরতে এবং তাদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করে।