মুগদা মানিকনগর সহ পাড়া-মহল্লায় ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে কিশোর গ্যাং
মুগদা মানিকনগর সহ পাড়া-মহল্লায় ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা.!
এম রাসেল সরকার:
রাজধানীর মুগদা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘কিশোর গ্যাং’ কালচার অনেকটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। প্রচলিত এবং পরিচিত আন্ডার ওয়ার্ল্ড এবং এর সঙ্গে জড়িত গডফাদার ও সন্ত্রাসীদের নাম, পরিচয় জানা গেলেও কিশোর গ্যাং-এর সঙ্গে জড়িতদের নাম-পরিচয় অজানা থেকে যায়। বিভিন্ন বিচিত্র নামে এসব কিশোর গ্যাং পাড়া-মহল্লায় ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে।
গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক এমনকি খুন-খারাবির সাথে জড়িয়ে পড়েছে।
অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের গ্রুপের নামে পেজ খুলে ঘোষণা দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করে। অপরাধ জগতে কিশোররা এখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। তারা বেপরোয়া এবং নিজের হিরোইজম দেখানোর জন্য যেকোনো অপরাধ করতে দ্বিধা করে না। তাদের এই বেপরোয়া আচরণকে ইন্ধন বা নতুন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী ও এলাকার রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল। তাদের নানা অপকর্মের সঙ্গে কিশোর গ্যাংকে জড়াচ্ছে। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতে তাদের ব্যবহার করছে। চপলমতি কিশোররা এলাকার বা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে নিজেদের ক্ষমতা দেখাতে উৎসাহী হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
রাজধানীর মুগদা মানিকনগর মান্ডা সহ কত সংখ্যক কিশোর গ্যাং রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীতে ৩৪টি ও র্যাবের হিসাবে অর্ধশত রয়েছে। তবে পত্র-পত্রিকার হিসাব অনুযায়ী, শতাধিক কিশোর গ্যাং রাজধানী জুড়ে রয়েছে। এদের বেশিরভাগই মুগদা মানিকনগর মান্ডা সবুজবাগ যাত্রাবাড়ী মিরপুর ও উত্তরায় সক্রিয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর গ্যাংয়ের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালী মহল তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য কিশোর গ্যাং ব্যবহার করছে। এলাকার বড় ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে তারা দুর্দমনীয় হয়ে উঠছে। যেকোনো অপরাধে তারা অবলীলায় জড়াচ্ছে।
গত এক বছরে তাদের হাতে খুন হয়েছে কয়েক ডজন। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে নিম্নবিত্তের সন্তানই নয়, উচ্চবিত্তের সন্তানরাও জড়িত। এর প্রধানতম কারণ, তাদের কিশোর মনের ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করা। এই হিরোইজম দেখাতে গিয়েই তারা ভয়ংকর হয়ে উঠছে। খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করাসহ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। সমাজের জন্য তারা বিষফোঁড়ায় পরিণত হচ্ছে। এজন্য সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক শাসন-বারণের অভাব, ধর্মীয় রীতি-নীতি থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। অভিভাবক শ্রেণীও তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। তাদের সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, কি করছে, শাসন-বারণের এই মৌলিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়েছে।
সন্তান সঠিক পথে রয়েছে কিনা, এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, সবধরনের অপরাধের মূলে রয়েছে মাদক। দেশে মাদকের যে ভয়াবহ বিস্তার চলছে,
গত এক সপ্তাহ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব চিত্র। প্রায় সবশ্রেণীর মানুষের মধ্যেই মাদকাসক্ত রয়েছে। এর সাথে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যও যুক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে মাদকাসক্তি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে তারা ভয়াবহ অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক নির্মূলে মাঝে মাঝে প্রশাসন থেকে শূন্য সহিষ্ণুতার কথা বলা হলেও তা অনেকটা কথার কথায় পরিণত হয়েছে। বহু বার বলা হয়েছে, মাদকের আমদানির উৎস এবং এর সাথে জড়িত মূল হোতাদের নির্মূল করা গেলে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ী ও বহনকারিদের গ্রেফতার কিংবা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার কথা শোনা গেলেও মাদকের গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক আমাদের দেশে খুব কম উৎপাদন হয়। এর মূল উৎস দেশের বাইরে এবং সেখান থেকে সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। কাজেই মাদক নিয়ন্ত্রণে মূল উৎস পথ বন্ধ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কিশোর গ্যাং দমন করা এখন চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে দমন করাও সম্ভব নয়।
উঠতি বয়সের কিশোর অপরাধী দমন সহজ বিষয় নয়। এদের গ্রেফতার এবং সাজা দিয়ে এর সমাধান হবে না। ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য গবেষণা প্রয়োজন। কেন ও কী কারণে কিশোররা অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে, মাদকাসক্ত হচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে হবে।
আমাদের দেশে এ নিয়ে গবেষণার কাজ হয় না বললেই চলে। এখন এ নিয়ে সিরিয়াসলি গবেষণা করতে হবে। প্রয়োজনে দেশের বাইরের গবেষকদের যুক্ত করে তাদের নিয়ে গবেষণা করে কারণ ও প্রতিকার নির্ণয় করতে হবে। এ অনুযায়ী, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে অভিভাবক শ্রেণীকে সক্রিয় ও সচেতন হতে হবে। সন্তানের আচার-আচরণ ও চলাফেরার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
সন্তানকে অভিভাবকদের সময় দিতে হবে। কিশোর অপরাধ ঠেকাতে সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তাদের নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দিতে হবে। অপরাধ প্রবণ কিশোররা যাতে রাজনৈতিক ছত্রছায়া এবং আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও পড়া-মহল্লায় সচেতনতা ও সতর্কতা মূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।